দেশভাগের পরমুহূর্ত থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান পূর্বপাকিস্তানের ওপর প্রভূত্ব করতে থাকে। রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যায় অবহেলিত, বঞ্চিত, অপমানিত। উন্নয়ন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমরনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশকে সামান্যতম ছাড় দেয়নি। বরং তুলনামূলকভাবে বুদ্ধিমান বাঙালি স্বীয় মেধার বলে পাকিস্তানীদের চাইতে বেশি প্রাধান্য পেতে পারে এই আশংকায় তারা আতংকিত ছিল। তাই তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালির প্রতিবাদী চেতনাকে ধ্বংস করতে চায়। নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড় থেকে উপড়ে ফেলার ষড়যন্ত্রে তারা প্রথমে হাত দেয় বাংলা ভাষার উপর।
এর ধারাবাহিকতায় আসে মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় দুই থেকে চার লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করে। বাঙালি জাতির বিদ্রোহী জাতিসত্ত্বা ধ্বংস করে পাকিস্তানী পিতার প্রতি অনুগত থাকবে এমন এক শংকর প্রজন্ম তৈরি করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এর মাধ্যমে তারা 'এথনিং ক্লিনজিং' এর উদ্যোগ নিয়েছিল। যার ফলে যুদ্ধ শেষে জন্ম নেয় প্রায় পঁচিশ হাজার যুদ্ধশিশু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিশুদের নাম দিয়েছিলেন 'বীরাঙ্গনা-শিশু'। তাদের ঠিকানা দিয়েছিলেন নিজের ধানমন্ডির বাড়ির ঠিকানা। কিন্তু তবুও বাংলাদেশের বাঙালি সমাজ এই অসহায় শিশুদেরকে গ্রহণ করে নি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী জামাত-রাজাকার-আলবদর-আলশামস গোষ্ঠী কর্তৃক ধর্ষিত বাঙালি মায়ের সন্তানদের বিদেশে দত্তক শিশু হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ এই শিশুদেরকে নিজভূমিতে আশ্রয় দেয়নি। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও ডেনমার্কের মানবতাবাদী মানুষেরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অপ্রত্যাশিত ফসল হিসেবে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশুদেরকে দত্তক নিয়েছিল। 'একাত্তরের যুদ্ধশিশু' বইতে লেখক সাজিদ হোসেন এক মানবিক বোধ থেকে বিষয়টির অবতারণা করেছেন। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রসঙ্গটির আলোচ্য হিসেবে উপযোগিতা প্রমাণ করতে চেয়েছেন।
সাজিদ হোসেনের লেখা 'একাত্তরের যুদ্ধশিশু' বইটি মূলত একটি গবেষণাগ্রন্থ। বিভিন্ন প্রসঙ্গ যথাযথ তথ্য, পরিসংখ্যান, বিশেষজ্ঞদের বিবরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সূচীপত্রটি দেখলেই বইটির গুরত্ব স্পষ্টতর হবে।
আরও
0 মন্তব্যসমূহ