গ্রন্থকার ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠকালীন সময়ে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতি, সাংস্কৃতিক উদারতা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, প্রতিদিনের জীবনাচরণ, প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি ঘনিষ্ঠতা ইত্যাদির সাথে পরিচিত হয়ে মুগ্ধ হয়েছেন। মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি এক অপার ভালোবাসার বীজ নিজের হৃদয়ে রোপন করেছেন। বিশ্বমানবতার আত্মিক জয়গান নিজের হৃদয়ে অনুভব করেছেন। এইসব বিবিধ বিষয় নিয়েই আলোচ্য গ্রন্থ "শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ"। লেখকের সাংস্কৃতিক অন্বেষণের পূর্ণতা পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে এসে। সেটাই তিনি আলোচনা করেছেন গ্রন্থের পাতায় পাতায়।

বস্তুতঃ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে পাঠকালীন সময়ে শান্তিনিকেতন থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থটির বিভিন্ন রচনাগুলির প্রধান আলোচ্য বিষয়। আমি আমার আলোচনায় বিষয়টিকে উপস্থাপন করার প্রচেষ্টা নিয়েছি।

গ্রন্থের মূল উপজীব্যঃ
আলোচ্য গ্রন্থটির মূল উপজীব্য বিষয় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত "শান্তিনিকেতন"। এই বিশ্বখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্রে লেখক ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর ছাত্র জীবন কেমন কাটিয়েছেন, তা আগ্রহভরে বর্ণনা করেছেন এই বইটিতে। ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে লেখক উপস্থিত হন শান্তিনিকেতনে। অসংখ্য পাখ-পাখালির ডাকে তিনি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠতেন। আম-জাম, কাঁঠাল-লিচু, হরিতকী, শাল, শাতিম তলায় ছায়াঘন পরিবেশে ক্লাশ করতেন। এক মুগ্ধ আবেশে সারাটা দিন কিভাবে কেটে যেত লেখক যেন তা বুঝতেই পারতেন না। শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা রাস্তা, গাছ, পাখি, মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, ক্লাশ, অবারিত নৈসর্গিক দৃশ্য, গ্রাম, নদী ইত্যাদি নিয়েই সমৃদ্ধ হয়েছে লেখকের ছাত্রজীবন।

বইটির গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতাঃ
বাংলা গ্রন্থ তালিকায় বইটির গুরুত্ব একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাঙালিরা আর একটিও তৈরি করতে পারেনি। এই বিদ্যানিকেতনের শিক্ষাদান পদ্ধতি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, ছাত্র-ছাত্রী সম্পর্ক বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার চর্চা সবকিছুই ছিল অনন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তিজীবনে যে উদার ও বৈশ্বিক মানবতার লালন নিজ জীবনে প্রয়োগ করেছেন, প্রাত্যাহিক জীবনাচারে মেনে চলতেন- তার প্রতিফলন দেখি শান্তিনিকেতনের সামাজিক জীবনে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের ব্যক্তিজীবনেও রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে বহন করে চলতেন। শিক্ষার্থীদের জীবনগঠনপ্রক্রিয়ার সামগ্রিক রূপ জানা সম্ভব এই গ্রন্থটি পাঠের মাধ্যমে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেসব দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আদর্শ ও পরিচালনা পদ্ধতির সাথে পরিচিত হবার চেষ্টা করতেন। ফলে শিক্ষার আদর্শ ও লক্ষ্যের মূলভাব তিনি অনুভব করতে পেরেছেন। এছাড়াও প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমের বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রভাবনায় সমুজ্জ্বল ছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে প্রাচীন ঋষিগণের শিক্ষাভাবনার সাথে বৈশ্বিক আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষাপদ্ধতির অভূতপূর্ব মিলন ঘটেছে। ফলে শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছে এক উন্নত রুচিশীল মানবাদর্শের তীর্থক্ষেত্র।

বিস্তারিত